পূর্ব বর্ধমান জেলা হল পশ্চিমবঙ্গের জেলা গুলির মধ্যে একটি অন্যতম উল্লেখযােগ্য জেলা। এই জেলা বর্ধমান বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। বর্ধমান হল এই জেলার প্রধান শহর এবং প্রশাসনিক সদর দফতর।
এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে আমরা জানব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি বিশিষ্ট জেলা পূর্ব বর্ধমান জেলার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
![]() |
Introduction of Purba Bardhaman or East Burdwan District |
✪ পূর্ব বর্ধমান জেলা (Purba Bardhaman or East Burdwan District) :
❂ প্রতিষ্ঠিত :
পূর্ব বর্ধমান জেলাটি গঠিত হয় ৭ই এপ্রিল ২০১৭ সালে।
❂ আয়তন :
পূর্ব বর্ধমান জেলার মােট আয়তন ৫,৪৩৩ বর্গ কিলােমিটার।
❂ জনসংখ্যা :
পূর্ব বর্ধমান জেলার মােট জনসংখ্যা ৪৮,৩৫,৫৩২ জন।
- পুরুষ জনসংখ্যা : ৫১.০৭ %
- মহিলা জনসংখ্যা : ৪৮.৯৩ %
- জনসংখ্যার ঘনত্ব : ৮৯০ জন প্রতি বর্গ কিমি
- জনসংখ্যার অনুপাত (গ্রামীণ) : ৮৪.৯৮ %
- জনসংখ্যার অনুপাত (নাগরিক) : ১৫.০২ %
- কর্মী : ৪০.৩৬ %
- কর্মহীন : ৫৯.৬৪ %
❂ সীমানা :
পূর্ব বর্ধমান জেলার ভৌগলিক সীমানা হল - উত্তরে বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলা, দক্ষিণে হুগলি জেলা, পূর্বে নদীয়া জেলা এবং পশ্চিমে বাঁকুড়া ও পশ্চিম বর্ধমান জেলা।
❂ নামকরণ :
বর্ধমান নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মতামত রয়েছে। জৈনদের কল্পসূত্র অনুসারে মহাবীর এই অঞ্চলের অষ্টিকগ্রামে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন, যিনি পূর্বে বর্ধমান নামেও পরিচিত ছিলেন। অন্য একটি মতে, বর্ধমান মানে সমৃদ্ধ বৃদ্ধি কেন্দ্র, উচ্চ গঙ্গা উপত্যকা থেকে আর্যানাইজেশনের অগ্রগতিতে, সীমান্ত উপনিবেশকে বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে বর্ধমান বলা হত। আর এই বর্ধমান নাম থেকে বর্ধমান জেলা এবং বর্ধমান জেলার বিভক্তিত রূপের পূর্ব অংশ পূর্ব বর্ধমান নামে প্রকাশিত হয়।
❂ ইতিহাস :
ইতিহাস অনুযায়ী ১৭৯৩ সালে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য লর্ড কর্ণওয়ালিশ দ্বারা জেলা হিসাবে বর্ধমানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পরবর্তীকালে ৭ই এপ্রিল ২০১৭ সালে এই বর্ধমান জেলাটিকে বিভক্ত করে পূর্ব অংশকে পূর্ব বর্ধমান জেলা হিসাবে গঠিত করা হয়।
❂ প্রশাসনিক বিভাগ :
✪ জেলা সদর : পূর্ব বর্ধমান জেলার জেলা সদর -
- বর্ধমান সদর।
✪ মহকুমা : পূর্ব বর্ধমান জেলার মহাকুমা ৪টি, এগুলি হল -
- বর্ধমান সদর উত্তর,
- বর্ধমান সদর দক্ষিণ,
- কাটোয়া ও
- কালনা।
✪ পৌরসভা : পূর্ব বর্ধমান জেলার পৌরসভা ৬টি, এগুলি হল -
- বর্ধমান,
- মেমারি,
- গুসকরা,
- কালনা,
- কাটোয়া ও
- দাঁইহাট পৌরসভা।
✪ ব্লক : পূর্ব বর্ধমান জেলার ব্লক সংখ্যা হল ২৩টি, এগুলি হল -
- আউশগ্রাম-১,
- আউশগ্রাম-২,
- গলসি-১,
- গলসি-২,
- খন্ডঘোষ,
- বর্ধমান-১,
- বর্ধমান-২,
- ভাতাড়,
- রায়না-১,
- রায়না-২,
- জামালপুর,
- মেমারি-১,
- মেমারি-২,
- মন্টেশ্বর,
- মঙ্গলকোট,
- কেতুগ্রাম-১,
- কেতুগ্রাম-২,
- কাটোয়া-১,
- কাটোয়া-২,
- পূর্বস্থলী-১,
- পূর্বস্থলী-২,
- কালনা-১ ও
- কালনা-২
✪ থানা : পূর্ব বর্ধমান জেলায় ১৮টি থানা রয়েছে।
✪ সেন্সাস টাউন : পূর্ব বর্ধমান জেলায় রয়েছে ২০টি সেন্সাস টাউন।
✪ পঞ্চায়েত সমিতি : পূর্ব বর্ধমান জেলায় ২৩টি পঞ্চায়েত সমিতি রয়েছে।
✪ গ্রাম পঞ্চায়েত : পূর্ব বর্ধমান জেলায় ২১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে।
✪ ডাক ঘর : পূর্ব বর্ধমান জেলায় ডাক ঘর রয়েছে ৭৭০টি।
✪ গ্রাম : পূর্ব বর্ধমান জেলায় ২১০২টি গ্রাম রয়েছে।
✪ মৌজা : পূর্ব বর্ধমান জেলায় ২১৭৭টি মৌজা রয়েছে।
✪ গ্রাম সংসদ : পূর্ব বর্ধমান জেলায় রয়েছে ৩২৩২টি গ্রাম সংসদ।
✪ জেলা পরিষদ : পূর্ব বর্ধমান জেলার জেলা পরিষদের সংখ্যা ১টি।
✪ লােকসভা কেন্দ্র : পূর্ব বর্ধমান জেলায় লােকসভা কেন্দ্র রয়েছে ৪টি, এগুলি হল -
- বর্ধমান-দূর্গাপুর,
- বর্ধমান পূর্ব,
- বিষ্ণুপুর ও
- বােলপুর।
✪ বিধানসভা কেন্দ্র : পূর্ব বর্ধমান জেলায় বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে ১৬টি।
❂ ভূ-প্রকৃতি :
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা এই পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য্যও অপরূপ। এই জেলার ভূমিভাগ সমতল এবং এটি একটি পলল সমভূমি অঞ্চল, যা চারটি বিশিষ্ট টপোগ্রাফিক অঞ্চলে বিভক্ত। সম্পূর্ণ জেলা জুড়ে প্রচুর পুষ্করিণী দিঘি, কূপ, খাল, জলা এবং বিল দেখতে পাওয়া যায়।
❂ নদ-নদী :
পূর্ব বর্ধমান জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত উল্লেখযােগ্য নদনদীগুলি হল - দামােদর, ভাগীরথী অজয়, ব্রাহ্মণী সিঙ্গারাম, বেহুলা গাঙ্গুর ইত্যাদি।
❂ জলবায়ু :
পূর্ব বর্ধমান জেলার জলবায়ু গ্রীষ্মমন্ডলীয় গরম এবং আর্দ্র। এই জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিন্ম তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই জেলার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৩৪৭ মিমি।
❂ কৃষিকাজ :
পূর্ব বর্ধমান পশ্চিমবঙ্গের একটি কৃষিকাজ সমৃদ্ধ জেলা। এই জেলার মাটি ও জলবায়ু খাদ্যশস্য উৎপাদনের পক্ষে বিশেষ উপযােগী। এই জেলায় ধান, গম, ভুট্টা, আলু থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের শাকসবজি, ফলমূল ও তৈলবীজ উৎপাদিত হয়। অবিভক্ত বর্ধমান জেলা ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম স্থানে ছিল এবং এর বেশির ভাগই উৎপাদন হত বর্তমান এই পূর্ব বর্ধমান জেলা থেকে।
❂ ভাষা :
পূর্ব বর্ধমান জেলায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষদের প্রধান ভাষা হল বাংলা, তবে এই জেলায় সাঁওতালি, হিন্দি, উর্দু প্রভৃতি আরাে অন্যান্য ভাষাও প্রচলিত।
❂ সাক্ষরতা :
পূর্ব বর্ধমান জেলার মােট শিক্ষার হার ৭৫.৪৮ শতাংশ।
- শিক্ষিত পুরুষ : ৮১.২৭ %
- শিক্ষিত মহিলা : ৬৯.৪৩ %
❂ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান :
পূর্ব বর্ধমান জেলার উল্লখযােগ্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠন হল -
- দ্য ইউনিভার্সিটি অফ বর্ধমান
- বর্ধমান রাজ কলেজ
- বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ
- চন্দ্রপুর কলেজ
- কালনা কলেজ
- কাটোয়া কলেজ
- মেমারি কলেজ
- বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয় ইত্যাদি।
❂ পরিবহন ব্যবস্থা :
পূর্ব বর্ধমান জেলায় পরিবহন ব্যবস্থা হিসাবে উন্নত সড়কপথ তাে রয়েছেই সঙ্গে রেলপথও রয়েছে। এই জেলার কয়েকটি উল্লেখযােগ্য রেলস্টেশন হল - বর্ধমান জংশন রেলস্টেশন, কাটোয়া জংশন রেলস্টেশন, গুসকরা রেলস্টেশন, আমবিকা কালনা রেলস্টেশন, মেমারি রেলস্টেশন ইত্যাদি।
❂ বিশিষ্ট ব্যক্তি :
পূর্ব বর্ধমান জেলার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেন -
✩ অক্ষয়কুমার দত্ত : বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক।
✩ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত : একজন বাঙালি কবি, যাকে ছড়ার জাদুকর বলা হয়।
✩ ড. সুকুমার সেন : একজন বিখ্যাত বাঙালি ভাষাবিদ ছিলেন।
✩ রাজশেখর বসু : একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা।
✩ রাসবিহারী বােস : ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে একজন ভারতীয় বিপ্লবী এবং নেতা ছিলেন।
- প্রমুখ।
❂ দর্শনীয় স্থান :
পূর্ব বর্ধমান জেলার উল্লেখযােগ্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল -
✽ লর্ড কার্জন গেট : শ্রী বিজয় চাঁদ মহাতাবের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে, বর্ধমানের মহারাজা ১৯০৩ সালে জি.টি রােড এবং বি.সি রােডের সংযােগস্থলে এই বিশাল তােরণটি তৈরি করেছিলেন।
✽ সর্বমঙ্গলা মন্দির : ১৭০২ সালে মহারাজা কীর্তিচাঁদ দ্বারা সর্বমঙ্গলা মন্দরটি নির্মিত হয়েছিল। এটি বর্ধমানের ডি.এন সরকার রােডে অবস্থিত। মন্দিরের মাতা সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি প্রায় ১০০০ বছর পুরোনো৷ এটি অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন মন্দির।
✽ ১০৮ শিব মন্দির : সিউড়ি রােডে নবাবহাট বাস টার্মিনাসের কাছে প্রশস্ত শিব মন্দিরটি অবস্থিত। ১০৮টি মন্দিরের একটি আয়তক্ষেত্রাকার মালা হিসাবে এই ১০৮ শিব মন্দিরটি ১৭৮৮ সালে মহারাজা তিলােকচন্দনের স্ত্রী মহারাণী বিষ্ণান কুমারী নির্মাণ করেছিলেন।
✽ শের আফগানের সমাধি : শের আফগানের সমাধিটি রাজবাটির নিকটে পীর বাহারমের পাশে অবস্থিত।
✽ কঙ্কালেশ্বরী কালী মন্দির : কঙ্কালেশ্বরী কালী মন্দিরটি বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগরে অবস্থিত। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে দামােদরের পাশের নদীতে মন্দিরের কালী প্রতিমাটি পাওয়া গিয়েছিল।
এছাড়াও -
✽ অট্টহাস সতী পীঠ মন্দির
✽ চুপি চর
✽ কালনা রাজবাড়ি মন্দির
✽ খ্রিস্ট গির্জা
✽ খাজা আনােয়ার বেড় নবাব বাড়ি
✽ ঝুলন্ত রেলওয়ে ওভারব্রিজ ইত্যাদি।
এই হল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি বিশিষ্ট জেলা পূর্ব বর্ধমান জেলার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
0 মন্তব্যসমূহ